মোক্তার হোসেন, পাংশাঃ মুক্তিযুদ্ধের চেতনাসমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তুলতে হলে জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গড়ে তোলার কোন বিকল্প নেই। আর জ্ঞানের আধার হচ্ছে গ্রন্থাগার। কথ্যগদ্যের প্রবর্তক প্রমথ চৌধুরী গ্রন্থাগার তথা পাঠাগারকে স্কুল কলেজের উপরে স্থান দিয়েছেন। এ স্থলে লোকে স্বেচ্ছায় স্বচ্ছন্দ চিত্তে স্ব-শিক্ষিত হবার সুযোগ পায়। চেতনার বিপ্লবে বইয়ের বিকল্প নেই। তাই গ্রন্থাগারে আসুন, বই পড়ুন।
এ আহবান বুকে ধারণ করে প্রতিষ্ঠার ৫৭ বছর ধরে জ্ঞানের আলো ছড়াচ্ছে এয়াকুব আলী স্মৃতি পাঠাগার ও ক্লাব।
জানা যায়, ১৯৬৫ সালের ৩ জানুয়ারী পাংশা শহরে সাহিত্যিক এয়াকুব আলী চৌধুরীর নামে জ্ঞানভিত্তিক সমাজ বিনির্মাণের প্রত্যয় নিয়ে পাঠাগারটি প্রতিষ্ঠা করা হয়।
প্রতিষ্ঠাকালীন সময়ে কমিটিতে যারা ছিলেন- প্রধান পৃষ্ঠপোষক কাজী আজিজুল ইসলাম (মহকুমা প্রশাসক, গোয়ালন্দ), পৃষ্ঠপোষক কাজী আব্দুল মাজেদ, সৈয়দ মাহবুব, কে.এম আয়েজউদ্দীন ও পশুপতি কুন্ডু।
সভাপতি ডাঃ মোঃ আবদুল কাদের (চেয়ারম্যান, পাংশা ইউপি), সহ-সভাপতি কাজী আবুল কালাম আজাদ, সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক মুহম্মদ আবদুল ওয়াহাব, যুগ্ম সম্পাদক মোঃ সিরাজুল ইসলাম, কোষাধ্যক্ষ আলহাজ্ব রহমত আলী বিশ্বাস, সদস্য কে.এম রওশন আলী, হরিনাথ নন্দী, গওহর উদ্দীন মন্ডল, আমজাদ আলী চৌধুরী, আবুল মাহমুদ, ডাঃ সুধীর কুমার দে, মনোরঞ্জন কুন্ডু, অমল কুমার দে, সৈয়দ ফখরুদ্দীন মাহমুদ, ডাঃ আবদুল আজিজ ও এ.কে.এম নুরুন্নবী।
মোঃ মনজুর কাদের মাসুদের সৌজন্যে এ সংক্রান্ত নামফলক স্থাপন করা হয়েছে এবং রাজবাড়ী-২ আসনের জাতীয় সংসদ সদস্য ও রাজবাড়ী জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা মোঃ জিল্লুল হাকিম ২০১৪ সালের ২১ জুলাই বিকেলে পাঠাগারে উক্ত ফলক উদ্বোধন করেন।
এদিকে, পাঠাগারটি আরও সমৃদ্ধ করার লক্ষ্যে বর্তমান কমিটি পাঠাগারের দ্বিতীয় তলায় বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ কর্নার স্থাপন করেছে।
গত ১০ ফেব্রুয়ারী বিকেলে বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ কর্নার উদ্বোধন করা হয়। পাংশা উপজেল নির্বাহী অফিসার ও এয়াকুব আলী চৌধুরী স্মৃতি পাঠাগারের সভাপতি মোহাম্মাদ আলী, পাঠাগারের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল আল মাসুদ বিশ্বাস, পাংশা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও পাঠাগারের উপদেষ্টা ফরিদ হাসান ওদুদ, পাংশা পৌরসভার মেয়র ও পাঠাগারের উপদেষ্টা মোঃ ওয়াজেদ আলী, পাঠাগারের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক চিত্ত রঞ্জন, পাঠাগারের কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য নওশাদ আলী চৌধুরী (বাবুল চৌধুরী), সৈয়দ নূর ই আলম ইমরোজ, অধ্যক্ষ মুক্তিযোদ্ধা এসএম কায়কোবাদ, অধ্যক্ষ মোঃ আব্দুল মান্নান, এয়াকুব আলী চৌধুরী বিদ্যাপীঠের প্রধান শিক্ষক মোঃ মোতাহার হোসেন প্রমূখ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন।
তথ্য অনুসন্ধানে জানা যায়, ১/৯/২০০৫ সমাজ কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সহকারী সচিব মোঃ জাহেদুল ইসলাম, ৪/২/২০০৬ পাংশা উপজেলা নির্বাহী অফিসার খাজা আব্দুল হান্নান, ৩০/৯/২০১১ রাজবাড়ী সরকারী গ্রন্থাগারের লাইব্রেরিয়ান এএইচএম কামরুজ্জামান, ২২/১০/২০১৩ ঢাকার কেন্দ্রীয় পাবলিক লাইব্রেরীর মহাপরিচালক নূর হোসেন তালুকদার, ১০/০২/২০১৪ আকিদুল ইসলাম, ২৭/১১/২০১৪ ইফতেখার রফিক, ২৯/১২/২০১৪ ডিডিসি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইঞ্জিনিয়ার একেএম রফিক উদ্দিন, ১২/১/২০১৫ জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজী বিভাগের শিক্ষক এম সাইফুল আরেফীন, ২৪/৪/২০১৫ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের সচিব খোন্দকার মোঃ আসাদুজ্জামান, ০৭/০৫/২০১৫ প্রবন্ধিক ও সাহিত্য সমালোচক জামিরুল ইসলাম শরীফ, ২২/১২/২০১৬ রাজবাড়ীর জেলা প্রশাসক জিনাত আরা, ১৮/৭/২০১৬ পাংশা উপজেলা নির্বাহী অফিসার মোহাম্মদ আমিনুল ইসলাম খান, ২৫/৩/২০১৭ ও ২৬/৮/২০১৭ প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব রাম চন্দ্র দাস, ১৩/১১/২০১৭ রাজবাড়ী সরকারী গ্রন্থাগারের লাইব্রেরিয়ান জান্নাতুল ফেরদৌস, ২৮/৪/২০১৮ অতিরিক্ত সচিব রাম চন্দ্র দাস, ১৯/৬/২০১৮ রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ডক্টর নাজমুল আহসান কলিমুল্লাহ, ১০/১/২০১৯ ঢাকা বিভাগীয় কমিশনার কেএম আলী আজম, ১৬/১২/২০২০ বাংলাদেশ পুলিশ সিআইডি ঢাকার সহকারী পুলিশ সুপার ফাতেমা তুজ জোহরাসহ বাংলাদেশের সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার মোহাম্মদ আবু হেনা, ডিডিসি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইঞ্জিনিয়ার এ.কে.এম রফিক উদ্দিন, মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (গ্রেড-১) রাম চন্দ্র দাস, ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার নাসিরনগর সরকারী কলেজের অধ্যাপক জামিল ফোরকান (বাচিক শিল্পী, সম্পাদক ও গবেষক) একাধিকবারসহ সরকারী-বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা ও বিশিষ্ট ব্যক্তিরা বিভিন্ন সময়ে পাঠাগার পরিদর্শন করে পাঠাগার সমৃদ্ধকরণে জ্ঞানগর্ভ মন্তব্য লিপিবদ্ধ করেছেন।
২০১৮ সালের ২৭ আগস্ট পাঠাগার পরিদর্শনে এসে বাংলাদেশের সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার মোহাম্মদ আবু হেনা মন্তব্য বহিতে উল্লেখ করেন, “এয়াকুব আলী চৌধুরী অবিভক্ত বাংলার এক স্বনামধন্য সাহিত্যিক।
পাংশাবাসী ধন্য যে তাঁর জন্ম হয়েছিল রাজবাড়ীর এই উপজেলায়। তাঁর নামাঙ্কিত এয়াকুব আলী চৌধুরী স্মৃতি পাঠাগার ও ক্লাবে পাংশার গুণীজনদের সান্নিধ্যে আজ কিছু সময় কাটাতে পেরে আমি কৃতার্থ বোধ করছি।
কর্মজীবনে এয়াকুব আলী চৌধুরী শিক্ষকতা পেশায় নিয়োজিত ছিলেন। প্রখ্যাত সাহিত্য পত্রিকা ‘কোহিনূরের’ সম্পাদক ছিলেন। ‘শান্তিধারা’, ‘মানবমুকুট’, ‘নূরনবী’ ইত্যাদি রচনার জন্য তিনি বাংলা সাহিত্যে একটি বিশিষ্ট স্থান দখল করে আছেন।
তাঁর স্মৃতি রক্ষার্থে স্থানীয় সুধীজনদের উদ্যোগে ১৯৬৫ সালে এই পাঠাগারটি প্রতিষ্ঠিত হয়। এর প্রতিষ্ঠাতা-সভাপতি ডাঃ মোঃ আবদুল কাদের ও প্রতিষ্ঠাতা-সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক মুহম্মদ আবদুল ওয়াহাব। তাঁদের নেতৃত্বে পাঠাগারটি উল্লেখযোগ্য উন্নতি ঘটে। পরবর্তীকালে বিশেষ করে সত্তরের দশকে পাঠাগারটির উপর বিপর্যয় নেমে আসে।
২০১০ সালের দিকে সাহিত্যানুরাগী ব্যক্তিদের উদ্যোগে এবং প্রতিষ্ঠাতা-সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক আবদুল ওয়াহাবের ঐকান্তিক চেষ্টায় প্রতিষ্ঠানটি পুনর্জন্ম লাভ করে। বর্তমানে পাঠাগারটি সরকারীভাবে স্বীকৃত এবং বিভিন্ন শ্রেণির তিন সহস্রাধিক বইয়ের সমাহারে সমৃদ্ধ।
পাঠাগারের সংগ্রহে খ্যাতনামা লেখকদের রচনাবলী, বিশিষ্ট মনীষীদের আত্মজীবনী, বাংলাপিডিয়া, স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্র, মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর ভিত্তিক ইতিহাস দেখে আমি আনন্দিত হলাম। পাঠাগারের সদস্য সংখ্যা সন্তোষজনক। আশা করি, এর ব্যবহার আরো ব্যাপক ও পাঠক সংখ্যা আরো বৃদ্ধি পাবে।
পাংশা উপজেলায় এমন ধরণের পাঠাগার আর আছে বলে আমার জানা নেই। অনুরূপ মানের পাঠাগার বিভিন্ন এলাকায় আরো গড়ে তোলার প্রয়োজন।
এয়াকুব আলী চৌধুরী স্মৃতি পাঠাগারটিকে আরো সমৃদ্ধ কলেবরে মজবুত ভিতের উপর প্রতিষ্ঠিত করার উদ্যোগ নিতে সংশ্লিষ্ট সকলের প্রতি আহবান জানাই। পাঠাগার কক্ষের সম্প্রসারণ, আসবাবপত্র ও পুস্তক ক্রয়ের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দের প্রতি সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের সদয় দৃষ্টি আকর্ষণ করছি”।
এ ব্যাপারে এয়াকুব আলী চৌধুরী স্মৃতি পাঠাগারের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল আল মাসুদ বিশ্বাস ও লাইব্রেরিয়ান মোঃ মোকাদ্দেস হোসেন জানান, পাঠাগারে মোট ২০টি আলমারী আছে। আলমারীতে মোট ৩৫৭১ টি বই সংরক্ষিত আছে। এর মধ্যে ১৯৪টি বই রয়েছে দ্বিতীয় তলায় সদ্য স্থাপিত বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ কর্নারে। ২০টি আলমারীর মধ্যে ১৬টি আলমারী ও প্রায় একহাজার বই পাঠাগারে উপহার হিসেবে দিয়েছেন ইঞ্জিনিয়ার একেএম রফিক উদ্দিন।
পাঠাগারের নামে একটি এফডিআর ও কারেন্ট একাউন্ট আছে। সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়, সমাজ সেবা দপ্তরসহ বিশিষ্ট ব্যক্তিরা পাঠাগারে আর্থিক বরাদ্দ ও বই উপহার দিয়েছেন।
পাঠাগারের দাতা সদস্য রয়েছেন ৪০জন এবং আজীবন সদস্য রয়েছেন ১৫০ জন। সম্মানিত দাতা সদস্য ও আজীবন সদস্যদের নাম পাঠাগারের বোর্ডে লিখিত আছে।
২০১০ সালে পাঠাগারের সর্বশেষ কার্যনির্বাহী কমিটি গঠন করা হয়। ইতোমধ্যে কমিটির সহ-সভাপতি খান আব্দুল হাই ও কবির হোসেন, সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক মুহম্মদ আবদুল ওয়াহাব ও সদস্য ডাঃ এএফএম শফীউদ্দিন (পাতা) ইন্তেকাল করেছেন।
পাঠাগারের সাধারণ সম্পাদক, পাংশা পৌরসভার সাবেক মেয়র ও পাংশা উপজেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি মাসুদ বিশ্বাস আরও বলেন, বর্তমানে করোনা পরিস্থিতির কারণে নিয়মিত পাঠকের সংখ্যা কিছুটা কমেছে। স্মার্টফোনের যুগে শিক্ষার্থী ও তরুণ সমাজকে পাঠাগারমুখীকরণে কিছু কর্মপরিকল্পনা হাতে নিয়েছি। পাশাপাশি সাহিত্যিক এয়াকুব আলী চৌধুরীর স্মৃতি ধরে রাখতে তার সমাধিস্থলে স্মৃতি কমপ্লেক্স প্রতিষ্ঠার জন্য প্রচেষ্টা অব্যাহত আছে বলে জানান তিনি।